ঢাকা ০৫:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জীবন রক্ষায় স্মার্ট ক্যাম্পাস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থার রূপান্তর ভাবনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জাতির জাগরণের প্রতীক। এ বিদ্যাপীঠ জন্ম দিয়েছে বহু নেতার, চিন্তাবিদের, সংগ্রামী তরুণের। কিন্তু ছাত্রদের প্রাণহানির ঘটনা, সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা আর কোনো ছাত্রের নিথর দেহ দেখতে চাই না। আমাদের প্রত্যাশা—একটি নিরাপদ, মানবিক ও আধুনিক ক্যাম্পাস, যেখানে জ্ঞানচর্চা হবে ভয়হীনভাবে, দ্বন্দ্বহীনভাবে। এই লক্ষ্যেই এখানে একটি সমন্বিত প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস নিরাপত্তা মডেলের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো।
প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা: একটি সমন্বিত রূপরেখা


১. স্মার্ট নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ:
ক্যাম্পাসে AI ফেস রিকগনিশন, নাইট ভিশন ক্যামেরা, এবং কম্পিউটার ভিশনের সাহায্যে যেকোনো সহিংসতা, অস্ত্র প্রদর্শন বা সন্দেহজনক আচরণ আগেভাগে শনাক্ত করা সম্ভব। ক্রাউড হিটম্যাপ ব্যবহারে জমায়েতের ঘনত্ব বিশ্লেষণ করে ঝুঁকিপূর্ণ সময় নির্ধারণ করা যাবে।
২. ডিজিটাল পরিচয় ও প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ:
স্মার্ট আইডি ও বায়োমেট্রিক এক্সেস ব্যবস্থায় বহিরাগত অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব। ভিজিটর ট্র্যাকিং ও জিও-ফেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি গতিবিধি রেকর্ড ও পর্যবেক্ষণযোগ্য।
৩. মোবাইল অ্যাপ ও জরুরি সহায়তা:
অফিশিয়াল ক্যাম্পাস অ্যাপে ‘SOS Panic Button’, লোকেশন শেয়ার, অভিযোগ জানানো ও তা মনিটর করার সুবিধা থাকবে। ইন্টারনেট না থাকলেও USSD বা SMS ভিত্তিক জরুরি সতর্কতা পাঠানো যাবে।
৪. ড্রোন ও UAV পর্যবেক্ষণ:
উত্তেজনাকর সময় ড্রোনের মাধ্যমে আকাশপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। থার্মাল ক্যামেরা যুক্ত ড্রোন রাতে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিও শনাক্ত করতে সক্ষম।
৫. IoT ও স্মার্ট অবকাঠামো:
সেন্সরভিত্তিক স্মার্ট লাইট, সাইরেন, স্মার্ট লক, গ্যাস ও আগুন শনাক্তকারী অ্যালার্মসহ স্থায়ী হেল্প বুথ ছাত্রদের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
৬. মনিটরিং ও পূর্বাভাস বিশ্লেষণ:
বিগ ডেটা ও Predictive Analytics-এর মাধ্যমে কোন এলাকায় সহিংসতার ঝুঁকি বেশি তা পূর্বেই জানা যাবে। Emotion AI প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছাত্রদের মুখাবয়ব থেকে আতঙ্ক বা ক্রোধ বুঝে প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
৭. সাইবার সুরক্ষা ও গুজব মোকাবিলা:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, হুমকি বা উসকানিমূলক বক্তব্য শনাক্তে সাইবার ইনটেলিজেন্স ইউনিট ও ন্যারেটিভ মনিটরিং টুলের প্রয়োজন রয়েছে।
৮. প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা:
কঠোর আচরণবিধি, জিরো টলারেন্স নীতি, ও স্বাধীন ছাত্র-অভিযোগ নিষ্পত্তি কাঠামো (Student Ombudsman System) গড়ে তুলতে হবে।
৯. প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি:
নিরাপত্তাকর্মীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা, ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন এবং নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
১০. গবেষণা ও বাজেট বরাদ্দ:
নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথক সেল গঠন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে বার্ষিক অডিট ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
১১. বৈশ্বিক মডেল অনুসরণ:
হজ ব্যবস্থাপনা, হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডের স্মার্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
১২. অংশগ্রহণমূলক সুরক্ষা ব্যবস্থা:
শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীদের নিয়ে “Safe Campus Committee” এবং অভিভাবকদের সাথে সংযোগ রক্ষার জন্য Parent Update System চালু করতে হবে।

জীবনের দাবি: একটি মানবিক আবেদন
শিক্ষার্থীদের জীবন কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ, জাতির সম্ভাবনা। আমরা চাই না আর কোনো মা কাঁদুক, কোনো রুমমেট দগ্ধ দেহের পাশে দাঁড়িয়ে বিচলিত হোক। প্রযুক্তি শুধু নিরাপত্তা বাড়ায় না, এটি জীবন রক্ষা করে। তাই আমরা সরকারের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে, এবং সমগ্র জাতির কাছে আবেদন জানাই—প্রযুক্তি, নীতি ও মানবিকতাকে একত্র করে আমাদের শিক্ষাঙ্গনকে রক্ষা করুন। দরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগীতায় ক্যাম্পাসগুলোকে নিরাপদ করুন । ভারত বা পাকিস্তানেও ক্যাম্পাসে এতো লাশ পড়ে না । প্রশ্ন একটাই—বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ছাত্র মরবে? বই-খাতা নিয়ে আসা হাতে কেন লাশ হয়ে ফিরবে সন্তানের দেহ? একটি শিক্ষার্থীর মৃত্যু মানে একটি জাতির পরাজয়।

উপসংহার
এই সময় ইতিহাস গড়ার সময়। শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়া নয়, পূর্বপ্রস্তুতি চাই। নিরাপত্তা হোক আগাম দায়িত্ব, ছাত্রজীবন হোক নিরাপদ ও সৃজনশীল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ‘স্মার্ট, নিরাপদ ও মানবিক বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে গড়ে তুলতে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কেননা, প্রতিটি প্রাণ অমূল্য, প্রতিটি ছাত্রের জীবনই আমাদের ভবিষ্যৎ।

মুহাম্মদ ওমর ফারুক
লেখক ও চিন্তক
নির্বাহী পরিচালক, গ্লোবাল নলেজ ফাউন্ডেশন

ট্যাগ:

মটুয়া নাগরিক ফোরামের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত

জীবন রক্ষায় স্মার্ট ক্যাম্পাস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থার রূপান্তর ভাবনা

আপডেট: ০৪:৩৮:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জাতির জাগরণের প্রতীক। এ বিদ্যাপীঠ জন্ম দিয়েছে বহু নেতার, চিন্তাবিদের, সংগ্রামী তরুণের। কিন্তু ছাত্রদের প্রাণহানির ঘটনা, সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা আর কোনো ছাত্রের নিথর দেহ দেখতে চাই না। আমাদের প্রত্যাশা—একটি নিরাপদ, মানবিক ও আধুনিক ক্যাম্পাস, যেখানে জ্ঞানচর্চা হবে ভয়হীনভাবে, দ্বন্দ্বহীনভাবে। এই লক্ষ্যেই এখানে একটি সমন্বিত প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস নিরাপত্তা মডেলের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো।
প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা: একটি সমন্বিত রূপরেখা


১. স্মার্ট নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ:
ক্যাম্পাসে AI ফেস রিকগনিশন, নাইট ভিশন ক্যামেরা, এবং কম্পিউটার ভিশনের সাহায্যে যেকোনো সহিংসতা, অস্ত্র প্রদর্শন বা সন্দেহজনক আচরণ আগেভাগে শনাক্ত করা সম্ভব। ক্রাউড হিটম্যাপ ব্যবহারে জমায়েতের ঘনত্ব বিশ্লেষণ করে ঝুঁকিপূর্ণ সময় নির্ধারণ করা যাবে।
২. ডিজিটাল পরিচয় ও প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ:
স্মার্ট আইডি ও বায়োমেট্রিক এক্সেস ব্যবস্থায় বহিরাগত অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব। ভিজিটর ট্র্যাকিং ও জিও-ফেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি গতিবিধি রেকর্ড ও পর্যবেক্ষণযোগ্য।
৩. মোবাইল অ্যাপ ও জরুরি সহায়তা:
অফিশিয়াল ক্যাম্পাস অ্যাপে ‘SOS Panic Button’, লোকেশন শেয়ার, অভিযোগ জানানো ও তা মনিটর করার সুবিধা থাকবে। ইন্টারনেট না থাকলেও USSD বা SMS ভিত্তিক জরুরি সতর্কতা পাঠানো যাবে।
৪. ড্রোন ও UAV পর্যবেক্ষণ:
উত্তেজনাকর সময় ড্রোনের মাধ্যমে আকাশপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। থার্মাল ক্যামেরা যুক্ত ড্রোন রাতে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিও শনাক্ত করতে সক্ষম।
৫. IoT ও স্মার্ট অবকাঠামো:
সেন্সরভিত্তিক স্মার্ট লাইট, সাইরেন, স্মার্ট লক, গ্যাস ও আগুন শনাক্তকারী অ্যালার্মসহ স্থায়ী হেল্প বুথ ছাত্রদের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
৬. মনিটরিং ও পূর্বাভাস বিশ্লেষণ:
বিগ ডেটা ও Predictive Analytics-এর মাধ্যমে কোন এলাকায় সহিংসতার ঝুঁকি বেশি তা পূর্বেই জানা যাবে। Emotion AI প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছাত্রদের মুখাবয়ব থেকে আতঙ্ক বা ক্রোধ বুঝে প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
৭. সাইবার সুরক্ষা ও গুজব মোকাবিলা:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, হুমকি বা উসকানিমূলক বক্তব্য শনাক্তে সাইবার ইনটেলিজেন্স ইউনিট ও ন্যারেটিভ মনিটরিং টুলের প্রয়োজন রয়েছে।
৮. প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা:
কঠোর আচরণবিধি, জিরো টলারেন্স নীতি, ও স্বাধীন ছাত্র-অভিযোগ নিষ্পত্তি কাঠামো (Student Ombudsman System) গড়ে তুলতে হবে।
৯. প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি:
নিরাপত্তাকর্মীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা, ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন এবং নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
১০. গবেষণা ও বাজেট বরাদ্দ:
নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথক সেল গঠন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে বার্ষিক অডিট ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
১১. বৈশ্বিক মডেল অনুসরণ:
হজ ব্যবস্থাপনা, হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডের স্মার্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
১২. অংশগ্রহণমূলক সুরক্ষা ব্যবস্থা:
শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীদের নিয়ে “Safe Campus Committee” এবং অভিভাবকদের সাথে সংযোগ রক্ষার জন্য Parent Update System চালু করতে হবে।

জীবনের দাবি: একটি মানবিক আবেদন
শিক্ষার্থীদের জীবন কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ, জাতির সম্ভাবনা। আমরা চাই না আর কোনো মা কাঁদুক, কোনো রুমমেট দগ্ধ দেহের পাশে দাঁড়িয়ে বিচলিত হোক। প্রযুক্তি শুধু নিরাপত্তা বাড়ায় না, এটি জীবন রক্ষা করে। তাই আমরা সরকারের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে, এবং সমগ্র জাতির কাছে আবেদন জানাই—প্রযুক্তি, নীতি ও মানবিকতাকে একত্র করে আমাদের শিক্ষাঙ্গনকে রক্ষা করুন। দরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগীতায় ক্যাম্পাসগুলোকে নিরাপদ করুন । ভারত বা পাকিস্তানেও ক্যাম্পাসে এতো লাশ পড়ে না । প্রশ্ন একটাই—বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ছাত্র মরবে? বই-খাতা নিয়ে আসা হাতে কেন লাশ হয়ে ফিরবে সন্তানের দেহ? একটি শিক্ষার্থীর মৃত্যু মানে একটি জাতির পরাজয়।

উপসংহার
এই সময় ইতিহাস গড়ার সময়। শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়া নয়, পূর্বপ্রস্তুতি চাই। নিরাপত্তা হোক আগাম দায়িত্ব, ছাত্রজীবন হোক নিরাপদ ও সৃজনশীল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ‘স্মার্ট, নিরাপদ ও মানবিক বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে গড়ে তুলতে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কেননা, প্রতিটি প্রাণ অমূল্য, প্রতিটি ছাত্রের জীবনই আমাদের ভবিষ্যৎ।

মুহাম্মদ ওমর ফারুক
লেখক ও চিন্তক
নির্বাহী পরিচালক, গ্লোবাল নলেজ ফাউন্ডেশন